শক্তি কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি? শক্তির বিভিন্ন উৎস। বিভব শক্তি কি ব্যাখ্যা কর?
শক্তি কী?
শক্তি হচ্ছে কাজ করার ক্ষমতা! শুধু তা-ই না, যখন কোনো বস্তুর ওপর কোনো বল প্রয়োগ করে ধনাত্মক কাজ করা হয় তখন সেই বলটি আসলে বস্তুটির মাঝে একটা শক্তি সৃষ্টি করে। বস্তুটির মাঝে যতটুকু কাজ করা হয়েছে বস্তুটির মাঝে ততটুকু শক্তি সৃষ্টি হয় এবং যে বল প্রয়োগ করছে তাকে ঠিক সেই পরিমাণ শক্তি দিতে হয়। কাজেই এবারে তুমি নিশ্চয়ই খণাত্মক বা নেগেটিভ কাজের অর্থ বুঝতে পেরেছ। কোনো বল যদি কোনো বস্তুর উপর নেগেটিভ কাজ করে তাহলে বুঝতে হবে বস্তুর যেটুকু শক্তি ছিল সেখান থেকে খানিকটা শক্তি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেটুকু খণাত্মক বা নেগেটিভ কাজ করা হয়েছে ঠিক ততটুকু শক্তি সরিয়ে নেওয়া হয় এবং যে বল প্রয়োগ করেছে সে এই শক্তিটুকু কোনো না কোনোভাবে পেয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো বস্তুর উপর :ধনাত্মক কাজ করা ↣বস্তুটিকে শক্তি দেওয়া
খণাত্মক কাজ করা↣বস্তুটি থেকে শক্তি সরিয়ে নেওয়া
শক্তির একক J (জুল)
শক্তির মাত্রা W=ML2T-2
শক্তির বিভিন্ন রূপ
নানা ধরনের কাজের জন্য আমরা নানা ধরনের শক্তি ব্যবহার করি। যেমন পানি গরম করার জন্য তাপ শক্তির প্রয়োজন হয়, দেখার জন্য আমাদের আলো শক্তি লাগে, আমরা শুনি শব্দ শক্তি দিয়ে। বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে আমরা যন্ত্রপাতি চালাই আবার রাসায়নিক শক্তি ব্যবহার করে তড়িৎ কোষ বিদ্যুৎ তৈরি করি। ভারী নিউক্লিয়াস ভেঙে বা হালকা নিউক্লিয়াস জোড়া দিয়ে আমরা যে নিউক্লিয়ার শক্তি পাই সেটা দিয়েও বিদ্যুৎ শক্তি তৈরি করি। খাবার থেকে পুষ্টি নিয়ে আমাদের শরীরে শক্তি তৈরি হয়, আমরা কাজকর্ম করি!আমাদের সভ্যতার ইতিহাসটিই হচ্ছে শস্তি তৈরি করে সেই শক্তি ব্যবহারের ইতিহাস। আমরা আমাদের চারপাশে সেই শক্তির নানা রূপকে দেখতে পাই, যেমন-যাস্ত্রিক শক্তি, তাপ শক্তি, শব্দ শক্তি, আলোক শক্তি, চৌম্বক শক্তি, বিদ্যুৎ শক্তি, রাসায়নিক শক্তি, নিউক্লিয় শক্তি এবং সৌর শক্তি। শক্তির সবচেয়ে সাধারণ রূপ হচ্ছে যান্ত্রিক শক্তি, বস্তুর অবস্থান, আকার এবং গতির কারণে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকেই যাস্ত্রিক শক্তি বলে। যান্ত্রিক শক্তির দুটি রূপ হতে পারে গতিশস্তি এবং স্থিতিশস্তি।
গতি শক্তি
আমরা আগে বলেছি কাজ করার ক্ষমতা হচ্ছে শক্তি। আমরা সবাই জানি কোনো বস্তু গতিশীল হলে সেটা অন্য বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে সেটাকেও গতিশীল করে খানিকটা দূরত্ব ঠেলে নিয়ে যেতে পারে অন্য বস্তুকে গতিশীল করে ফেলার অর্থ নিশ্চয়ই সেখানে বল প্রয়োগ হয়েছে এবং সেই বলের জন্য খানিকটা দূরত্ব যাওয়ার অর্থ নিশ্চয়ই সেখানে কাজ হয়েছে! কাজেই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি গতির জন্য বস্তুর যে শক্তি হয় সেটা নিশ্চয়ই এক ধরনের শক্তি বা গতিশস্তি। আমরা জেনে অবাক হবো যে আমরা রাস্তাঘাটে যে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটতে দেখি সেখানে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার প্রধান কারণ এই গতিশস্তি। একটা বাস-ট্রাক বা গাড়ি যখন প্রচণ্ড বেগে ছুটতে থাকে তখন তার অনেক বড় গতিশস্তি থাকে। দুঘর্টনার সময় এই পুরো শক্তিটার কারণে গাড়ি ভেঙেচুরে যায়, প্রচণ্ড ধাক্কায় মানুষ মারা যায়। একটা বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে কাজ করা হলে সেখানে কতটুকু গতিশস্তি হবে সেটা আমরা খুব সহজে বের করতে পারি।
ধরা যাক F বল প্রয়োগ করে m ভরের একটা বস্তুকে s দূরত্ব সরানো হলো। তাহলে এই F বলের সম্পাদিত কাজ W হচ্ছে:বিভব শক্তি (Potential Energy)
কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা বলেছিলাম যখন কোনো বল কোনো কিছুর ওপর পজিটিভ কাজ করে তখন সেখানে শক্তির সৃষ্টি হয়। একটা বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে সেটাকে খানিকটা দূরত্বে নিয়ে গেলে গতিশস্তি বেড়ে যায়। এবারে এমন একটা উদাহরণ দেওয়া হবে, যেখানে বল প্রয়োগ করে খানিকটা দূরত্ব অভিক্রম করার পরও কোনো গতিশস্তি তৈরি হবে না। মনে করো টেবিলে একটা স্প্রিং চিত্রে দেখানো উপায়ে রাখা আছে, তুমি স্প্রিংয়ের খোলা মাথায় আঙুল দিয়ে F বল প্রয়োগ করে স্থিংটাকে x দূরত্বে সংকুচিত করে দিয়েছ। এ রকম অবস্থায় তোমার হাত বা স্প্রিং কোনোটাই গতিশীল না, তাই কোথাও কোনো গতিশস্তি নেই! যেহেতু যেদিকে F বল প্রয়োগ করা হয়েছে অভিক্রান্ত দূরত্বও x সেই দিকে, তাই কাজটি পজিটিভ, আমাদের কাজের সংজ্ঞা অনুযায়ী এখানে শক্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু সেই শক্তিটি কোথায়? কোনো কিছু গতিশীল নয়, তাই এখানে নিশ্চিতভাবে কোনো গতিশস্তি নেই আমরা যারা স্প্রিং ব্যবহার করেছি তারা অনুমান করতে পারছি যে সংকুচিত স্পরিংয়ের ভেতর নিশ্চয়ই শক্তিটুকু লুকিয়ে রয়েছে। কারণ আমরা জানি সংকুচিত স্প্রিংটার সামনে একটা m ভরের বস্তু রেখে স্প্রিংটা ছেড়ে দিলে স্প্রিংটা ভরটার ওপর বল প্রয়োগ করে একটা দূরত্ব অতিক্রম করাতে পারত, যার অর্থ কা করাতে পারত। অর্থাৎ এটি একটি শক্তি, গতিশস্তি না হলেও এটি অন্য এক ধরনের শক্তি। এই ধরনের সঞ্চিত শক্তিকে বলে বিভব শক্তি (Potential Energy) এই শক্তিটি কোনো বস্তুর অবস্থা বা অবস্থানের জন্য তৈরি হয়। একটি স্প্রিংয়ের ধ্রবক যদি K হয় এবং স্প্রিংটিকে যদি তার স্থির অবস্থার সাপেক্ষে x দূরত্ব সংকুচিত করা হয় তাহলে তার ভেতরে শক্তি সঞ্চিত হয়
শক্তির বিভিন্ন উৎস (Source of Energy)
অনবায়নযোগ্য শক্তি (Non-Renewable Energy)
জ্বালানি শন্তি (তেল, গ্যাস এবং কয়লা) :
এই মুহূর্তে পৃথিবীর শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তেল, গ্যাস বা কয়লা। তেল গ্যাস বা কয়লা তিনটিই হচ্ছে ফসিল জ্বালানি, অর্থাৎ লক্ষ-কোটি বছর আগে গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে দীর্ঘদিনের তাপ আর চাপে এই রূপ নিয়েছে। মাটির নিচ থেকে কয়লা, তেল আর গ্যাসকে তুলতে হয়। মাটির নিচ থেকে যে তেল তোলা হয় প্রাথমিক অবস্থায় সেগুলো অনেক ঘন থাকে, রিফাইনারিতে সেগুলো পরিশোধন করে পেট্রল, ডিজেল বা কেরোসিনে রূপান্তর করা হয় এবং সাথে সাথে আরো ব্যবহারযোগ্য পদার্থ বের হয়ে আসে। মাটির নিচ থেকে যে গ্যাস বের হয় সেটি মূলত মিথেন এর সাথে জলীয়বাষ্প এবং অন্যান্য গ্যাস মেশানো থাকতে পারে এবং সেগুলো আলাদা করে নিতে হয়। আমাদের বাংলাদেশের গ্যাস তুলনামূলকভাবে অনেক পরিষ্কার এবং সরাসরি ব্যবহার করার উপযোগী ।
নিউক্লিয়ার শক্তি:
অনেক দেশ নিউক্লিয়ার শক্তিকে ব্যবহার করছে, সেখানেও এক ধরনের জ্বালানির দরকার হয়, সেই জ্বালানি হচ্ছে ইউরেনিয়াম। তেল, গ্যাস, কয়লা বা ইউরেনিয়াম, এই শক্তিগুলোর মাঝে একটা মিল রয়েছে, এগুলো ব্যবহার করলে খরচ হয়ে যায়। মাটির নিচে কতটুকু তেল, গ্যাস, কয়লা আছে কিংবা পৃথিবীতে কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম আছে মানুষ এর মাঝে সেটা অনুমান করে বের করে ফেলেছে। দেখা গেছে পৃথিবীর মানুষ যে হারে শক্তি ব্যবহার করছে যদি সেই হারে শক্তি ব্যবহার করতে থাকে তাহলে পৃথিবীর শক্তির উৎস তেল, গ্যাস, কয়লা বা ইউরেনিয়াম দিয়ে টেনেটুনে বড়জোর দুই শত বছর চলবে। তারপর আমাদের পরিচিত উৎস যাবে ফুরিয়ে। তখন কী হবে পৃথিবীর মানুষ সেটা নিয়ে খুব বেশি দুর্ভাবনায় নেই, তার কারণ মানুষ মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই জানে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর মাঝে অন্য কিছু বের করে ফেলা হবে। যেমন নিউক্লিয়ার ফিউসান, যেটা ব্যবহার করে সূর্য কিংবা নক্ষত্রেরা তাদের শক্তি তৈরি করে। ফিউসানের জন্য জ্বালানি আসে হাইড্রোজেনের একটা আইসোটোপ থেকে, আর পানির প্রত্যেকটা অণুতে দুটো করে হাইড্রোজেন, কাজেই সেটা ফুরিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই।
নবায়নযোগ্য শক্তি (Renewable Energy)
শুধু যে ভবিষ্যতে নতুন ধরনের শক্তির ওপর মানুষ ভরসা করে আছে তা নয়, এই মুহূর্তেও তারা এমন শক্তির ওপর ভরসা করে আছে, যেগুলো ফুরিয়ে যাবে না। সেই শক্তি আসে সূর্যের আলো থেকে, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা কিংবা ঢেউ থেকে, উন্মুক্ত প্রান্তরের বাতাস থেকে, পৃথিবীর গভীরের উত্তপ্ত ম্যাগমা থেকে কিংবা নদীর বহমান পানি থেকে। বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে এই শক্তিগুলো বলতে গেলে অফুরন্ত । এগুলোকে বলা হয় নবায়নযোগ্য শক্তি অর্থাৎ যে শক্তিকে নবায়ন করা যায়, যে কারণে এটার ফুরিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব মানুষ যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এই নবায়নযোগ্য শস্তি। যত দিন যাচ্ছে মানুষ ততই পরিবেশ সচেতন হচ্ছে। তাই এ রকম শক্তির ব্যবহার আরো বেড়ে যাচ্ছে।
জলবিদ্যুৎ:
বিশ্বের শক্তির এক পঞ্চমাংশ হল নবায়নযোগ্য শক্তি। এর একটি বড় অংশ জলবিদ্যুৎ, নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন। নদীর পানি যেমন ফুরিয়ে যায় না, তেমনি এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎসও ফুরিয়ে যায় না। এটাই প্রচলিত প্রজ্ঞা। কিন্তু নদীতে বাঁধ দিলে পরিবেশের খুব ক্ষতি হয়, সেজন্য বিশ্ববাসী অনেক সতর্ক হয়েছে। একটু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর এভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে না।
বায়োমাস:
জলবিদ্যুতের পর নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস আসে বায়োমাস থেকে, যার অর্থ কাঠ, খড় ইত্যাদি। পৃথিবীর একটি বড় অংশের মানুষের কাছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ নেই, তারা কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবন কাটায়। এই দরিদ্র মানুষের ব্যবহারিক শক্তি পৃথিবীর মোট ক্ষমতার একটি বড় অংশ। শুকনো গাছের খড় পুড়িয়ে দিলে তা শেষ হয়। যাইহোক, বায়োমাসকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস বলা হয় কারণ এটি পুনরায় জন্মানো যায়। এটি তেল, গ্যাস বা কয়লার মতো পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয় না। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাস এই দুটি রূপের পরে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উত্সগুলি হল সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, জৈব জ্বালানী এবং ভূতাপীয় শক্তি ।
সৌরশক্তি:
শুনলে অনেকেই অবাক হবেন যে মাত্র এক বর্গকিলোমিটার এলাকা সূর্য থেকে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট তাপ পায়, যা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি। সূর্যের আলো ও তাপের একটি অংশ বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়, তা রাতে থাকে না, মেঘবৃষ্টির কারণে তা অনিয়ন্ত্রিত থাকে। তা ছাড়া শক্তি তাপ বা আলো হিসেবে আসে, তাকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার জন্য একটি পদক্ষেপ নিতে হবে। তবুও এটা বলা যেতে পারে যে এটি শক্তির একটি উৎস যার উপর আমরা খুব নির্ভরশীল। সূর্যের তাপ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। একটি আরও জনপ্রিয় পদ্ধতি হল এটি সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তর করা। আজকাল, বিশ্বে একটি পরিচিত দৃশ্য হল সোলার প্যানেল, লোকেরা তাদের বাড়ির ছাদে ইনস্টল করে তাদের বাড়িতে তাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ তৈরি করে।
তাহলে আজকে আমরা জানলাম শক্তি কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি? শক্তির বিভিন্ন উৎস। বিভব শক্তি কি ব্যাখ্যা কর? শক্তি মোট কত প্রকার ও কি কি? শক্তির উৎস কী? আলোক, সৌরশক্তি শক্তি কী?