ঘর্ষণ বল কাকে বলে? ঘর্ষণের প্রকারভেদ, ঘর্ষণ বলের সুবিধা ও অসুবিধা।
কোনো বস্তুর উপর অন্য বস্তুর ধাক্কা বা টানাই হচ্ছে বল প্রয়োগ। নিউটনের প্রথম সূত্র টি হলো ‘বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির ও গতিশীল বস্তু চিরকাল গতিশীল থাকবে’ ।কিন্তু বাস্তবে আমরা কোনো বস্তুকেই চিরকাল চলমান দেখিনা। এর কারণ ই হলো ঘর্ষণ বল। ঘর্ষণ বল বলের বিপরীতে কাজ করে যার ফলে কোনো বস্তু ই চিরকাল চলমান থাকে না। আজকে আমরা এই ব্লগে জানবো ঘর্ষণ বল কাকে বলে , প্রবাহী ঘর্ষণ কাকে বলে , আবর্ত ঘর্ষণ কাকে বলে , গতি ঘর্ষণ সহগ কাকে বলে , ঘর্ষণ বল কেন উৎপন্ন হয় , ঘর্ষণ বল কত প্রকার , ঘর্ষণ বলের বৈশিষ্ট্য ও ঘর্ষণ বলের উদাহারন । তাহলে চলুন জেনে নেই বিস্তারিত।
ঘর্ষণ বল কাকে বলে?
একটি বস্তু যখন আরেকটি বস্তুর উপর দিয়ে চলতে চেষ্টা করে অথবা চলতে থাকে তখন ঘর্ষণের কারণে যে বাঁধাদানকারী বলের সৃষ্টি হয় তাকে ঘর্ষণ বল বলে। নিচের কয়েকটি উদাহারন পড়লে সহজেই বুঝতে পারবে যে ঘর্ষণ বল কাকে বলে।ঘর্ষণ বলের উদাহারন
ধরা যাক, একটা টেবিলে কোনাে একটা কাঠের টুকরাে রয়েছে এবং সেই কাঠের টুকরাের ওপর বল প্রয়ােগ করে সেখানে ত্বরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। ধরা যাক, নিচের চিত্রে যেভাবে দেখানাে হয়েছে, সেভাবে ভরটির ওপর বাম থেকে ডানে F বল প্রয়ােগ করছি, দেখা যাবে কাঠের টুকরােয় টেবিলের সাথে কাঠের টুকরাের ঘর্ষণের কারণে একটা ঘর্ষণ বল f তৈরি হয়েছে এবং সেটি ডান থেকে বাম দিকে কাজ করে প্রয়ােগ করা বলটিকে কমিয়ে দিচ্ছে। কাঠের টুকরাের ওপরে যদি খানিকটা ওজন বসিয়ে দিই, দেখা যাবে ঘর্ষণ বল আরাে বেড়ে গেছে। ঘর্ষণ বল কীভাবে তৈরি হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই আমরা দেখব এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যদিও আপাতদৃষ্টিতে কাঠ, টেবিলকে কিংবা যে দুটো তলদেশের মাঝে ঘর্ষণ হচ্ছে অনেক মসৃণ মনে হয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে দেখা যাবে সব তলদেশেই এবড়ােথেবড়াে এবং এই এবড়ােথেবড়াে অংশগুলাে যখন একে অন্যকে স্পর্শ করে বা খাঁজগুলাে একে অন্যের সাথে আটকে যায়। সেটার কারণেই গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং আমরা বলি বিপরীত দিক থেকে ঘর্ষণ বলের জন্ম হয়েছে।
যদি দুটো তলদেশকে আরাে চাপ দেওয়া হয় তাহলে এবড়ােথেবড়াে অংশ আরাে বেশি একে অন্যকে স্পর্শ করবে, একটির খাঁজ অন্যটির আরাে গভীর খাঁজে ঢুকে যাবে এবং ঘর্ষণ বল আরাে বেড়ে যাবে।ঘর্ষণ বল কত প্রকার?
ঘর্ষণ বলকে চারভাগে ভাগ করা যায়। স্থিতি ঘর্ষণ, গতি ঘর্ষণ, আর্বত ঘর্ষণ এবং প্রবাহী ঘর্ষণস্থিতি ঘর্ষণ (static Friction)
দুটি বস্তু একে অন্যের সাপেক্ষে স্থির থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল থাকে, সেটা হচ্ছে স্থিতি ঘর্ষণ। স্থিতি, ঘর্ষণের জন্য আমরা হাঁটতে পারি, আমাদের পা কিংবা জুতাের তলা মাটিতে স্থিতি ঘর্ষণে আটকে থাকে এবং পিছলে পড়ে যাই না।
গতি ঘর্ষণ (sliding Friction)
আবর্ত ঘর্ষণ (Rolling Friction)
একটি তলের উপর যখন অন্য একটি বস্তু গড়িয়ে বা ঘুরতে ঘুরতে চলে, তখন সেটাকে বলে আবর্ত ঘর্ষণ। সবগুলাে ঘর্ষণ বলের মধ্যে এটা সবচেয়ে ছােট তাই আমরা সবসময়েই সকল রকম যানবাহনের মাঝে চাকা লাগিয়ে নেই। চাকা লাগানাে স্যুটকেস খুব সহজে টেনে নেওয়া যায় যদি এর চাকা না থাকত তাহলে মেঝের উপর টেলে নিতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হতাে।
প্রবাহী ঘর্ষণ (Fluid Friction)
যখন কোনাে বস্তু তরল বা বায়বীয় পদার্থের (Fluid) ভেতর দিয়ে যায়, তখন সেটি যে ঘর্ষণ বল অনুভব করে, সেটি হচ্ছে প্রবাহী ঘর্ষণ। প্যারাস্যুট নিয়ে যখন কেউ প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন বাতাসের প্রবাহী ঘর্ষণের কারণে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে পারে।
স্থিতি ঘর্ষণ এবং গতি ঘর্ষণের উদাহারনকয়েকটা ম্যাচের খালি বাক্স নাও। সেগুলাের ভেতরে মাটি ভরে বাক্সগুলাে খানিকটা ভারী করে নাও। এবারে একটা বইয়ের উপর ম্যাচ বাক্সটা রেখে বইটা ঢালু করতে থাকো। স্থিতি ঘর্ষণের কারণে ম্যাচটি গড়িয়ে যাবে না, তবে একটা নির্দিষ্ট কোণে গেলে ম্যাচ বাক্সটা গড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। এই অবস্থায় ম্যাচ বাক্সের গতি ঘর্ষণ কার্যকর হতে শুরু করেছে। একটা ম্যাচ বাক্সের উপর আরাে একটি বা কয়েকটি ম্যাচ বাক্স রেখে পরীক্ষাটি আবার করাে, দেখবে প্রতিবার তুমি একই ফলাফল পাবে। একাধিক ম্যাচবাক্স রেখে তুমি ওজন বাড়িয়ে স্থিতি ঘর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছ কিন্তু ঢালু করার সময় একই মাত্রায় ঢালের দিকে বলটি বেড়ে যাচ্ছে বলে ফলাফলের পরিবর্তন হচ্ছে না।
আমরা আগেই বলেছি ঘর্ষণ বল সবসময়েই প্রয়ােগ করা বলের বিপরীত দিকে কাজ করে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর্ষণ বল গতিকে কমিয়ে দেয় এবং আমাদের ধারণা হতে পারে আমরা সর্বক্ষেত্রে বুঝি ঘর্ষণ কমানাের চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি সত্যি নয়। তােমরা নিশ্চয়ই কখনাে না কখনাে কাদার মাঝে কোনাে গাড়ি বা ট্রাককে আটকে যেতে দেখেছ। তখন গাড়ির চাকা ঘুরলেও ঘর্ষণ কম বলে কাদা থেকে গাড়ি বা ট্রাক উঠে আসতে পারে না। চাকা পিছলিয়ে যায়। তখন গাড়ি বা ট্রাকটিকে তুলে আনার জন্য অন্যভাবে চাকা এবং কাদার মধ্যে ঘর্ষণ বাড়ানাের চেষ্টা করা হয়।
আরো পড়ুন : রসায়ন কি? রসায়ন কাকে বলে?.The Scope of Chemistry..
ঘর্ষণ বল বাড়ানাে ও কমানো
আমরা এর মাঝে জেনে গেছি যে আমাদের প্রয়ােজনে ঘর্ষণকে কখনাে বাড়াতে হয় এবং
কখনাে কমাতে হয়।
ঘর্ষণ বল কমানাে যায় কিভাবে?
ঘর্ষণ কমানাের জন্য আমরা যেসব কাজ করি সেগুলাে হচ্ছে:
১. যে পৃষ্ঠটিতে ঘর্ষণ
হয়, সেই পৃষ্ঠটিকে যত সম্ভব মসৃণ করা। মসৃণ পৃষ্ঠে গতি ঘর্ষণ কম।
২. তেল
মবিল বা গ্রিজ-জাতীয় পদার্থ হচ্ছে পিচ্ছিলকারী পদার্থ বা লুব্রিকেন্ট। দুটি তলের
মাঝখানে এই লুব্রিকেন্ট থাকলে ঘর্ষণ অনেকখানি কমে যায়।
৩. চাকা ব্যবহার করে
ঘর্ষণ কমানাে যায়। চাকা ব্যবহার করা হলে বড় গতি ঘর্ষণের পরিবর্তে অনেক ছােট
আবর্ত ঘর্ষণ দিয়ে কাজ করা যায়। ঘুরন্ত চাকাতে বল বিয়ারিং ব্যবহার করে সরাসরি
ঘর্ষণের বদলে ছােট স্টিলের বলগুলাের আবর্তন ঘর্ষণের সাহায্যে ঘর্ষণ অনেক কমানাে
সম্ভব।
৪. গাড়ি, বিমান এ ধরনের দ্রুতগামী যানবাহনের ডিজাইন এমনভাবে করা
হয়, যেন বাতাস ঘর্ষণ তৈরি না করে স্ট্রিম লাইন করা পৃষ্ঠদেশের উপর দিয়ে যেতে
পারে।
৫. যে দুটি পৃষ্ঠদেশে ঘর্ষণ হয়, তারা যদি খুব অল্প জায়গায় একে
অন্যকে স্পর্শ করে তাহলে ঘর্ষণ কমানাে যায়।
৬. আমরা দেখেছি ঘর্ষণরত দুটি
পৃষ্ঠে বল প্রয়ােগ করা হলে ঘর্ষণ বেড়ে যায়, কাজেই লম্বভাবে আরােপিত বল কমানাে
হলে ঘর্ষণ কমানাে যায়।
ঘর্ষণ বল বাড়ানাে যায় কিভাবে?
ঘর্ষণ কমানাের জন্য যে প্রক্রিয়াগুলাে করা হয়, সেগুলাে করা না হলে কিংবা তার বিপরীত কাজগুলাে করা হলেই ঘর্ষণ বেড়ে যায়। তাই ঘর্ষণ বাড়ানাের জন্য আমরা যে সব কাজ করি সেগুলাে হচ্ছে:
১. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হচ্ছে, সেগুলাে অমসৃণ বা খসখসে
করে তােলা।
২. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হয়, সেগুলাে আরাে জোরে চেপে ধরার ব্যবস্থা
করা।
৩. ঘর্ষণরত তল দুটির মাঝে গতিকে থামিয়ে স্থির করে ফেলা, কারণ স্থির
ঘর্ষণ গতি ঘর্ষণ থেকে বেশি।
৪. ঘর্ষণরত তলের মাঝে খাঁজ কাটা বা ঢেউ খেলানাে
করা। তাহলে এটি তলদেশকে জোরে আঁকড়ে ধরতে পারে। পানি বা তরল থাকলে সেটি খাঁজে
ঢুকে গিয়ে পৃষ্ঠদেশের ঘর্ষণ বাড়াতে পারে।
৫. বাতাস বা তরলের ঘনত্ব
বাড়ানাে।
৬. বাতাস বা তরলে ঘর্ষণরত পৃষ্ঠদেশ বাড়িয়ে দেওয়া।
৭. চাকা
বা বল বিয়ারিং সরিয়ে দেওয়া।
ঘর্ষণ একটি প্রয়ােজনীয় উপদ্রব
আমরা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি যে ঘর্ষণের কারণে তাপশক্তি তৈরি হয়। শীতের দিনে
আমরা হাত ঘষে হাত উত্তপ্ত করি। গাড়ির ইঞ্জিন যে গরম হয়ে ওঠে, সেটিও ঘটে ঘর্ষণের
কারণে। কাজেই ঘর্ষণের কারণে অপ্রয়ােজনীয়তা সৃষ্টি করে শক্তির অপচয় হয়। গাড়ি,
প্লেন, জাহাজ, সাবমেরিনকে ঘর্ষণ বলকে পরাস্ত করে এগিয়ে যেতে হয়, সেখানেও
অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করতে হয়। এভাবে দেখা হলে মনে হতে পারে ঘর্ষণ বুঝি আমাদের
জীবনের একটি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয়।
আবার আমরা এর মাঝে দেখেছি ঘর্ষণ আছে
বলেই আমরা হাঁটতে পারি, রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে, কাগজে পেন্সিল কলম দিয়ে লিখতে
পারি, দালান গড়ে তুলতে পারি, পারাস্যুট দিয়ে নিরাপদে নিচে নামতে পারি। আমরা এ
ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যেখানে ঘর্ষণ না থাকলে আমরা আমাদের প্রয়ােজনীয়
কাজগুলাে করতে পারতাম না। কাজেই ঘর্ষণকে উপদ্রব মনে করা হলেও আমাদের মেনে নিতে
হবে এটি আমাদের জীবনের জন্য খুবই প্রয়ােজনীয় একটি উপদ্রব।
শেষ কথা
আজকে এই পর্যন্তই। আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে ঘর্ষণ বল কাকে বলে, ঘর্ষণ বল কত প্রকার ও কি কি, স্থিতি ঘর্ষণ, গতি ঘর্ষণ, আবর্ত ঘর্ষণ ও প্রবাহী ঘর্ষণ কাকে বলে। আপনাদের জন্য রইলো শুভকামনা। আশা করি আপনাদের মূল্যবান মতামত কমেন্ট করে জানাবেন।